Uncategorized

পারফিউম অয়েল বেইজড আতর সর্ব প্রথম কে তৈরি করেছেন ?

প্রথমেই একটি হাদিস থেকে শুরু করি।
রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘চারটি বস্তু সব নবীর সুন্নত-আতর, বিয়ে, মিসওয়াক ও লজ্জাস্থান ঢেকে রাখা’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ২২৪৭৮)। 

এই হাদিস থেকে বুঝা যায় যেহুতু রাসূল সব নবী শব্দটি উল্যেখ করেছেন, পৃথিবীর প্রথম মহা-মানব হযরতে আদম আঃ সুগন্ধী ব্যাবহার করেছেন।
এর দ্বারা বুঝা যায় পৃথিবীর শুর থেকেই সুগন্ধীর ব্যাবহার শুরু হয়েছে । প্রাচিন আমলে বিভিন্ন ভাবে সুগন্ধী ব্যাবহার করা হত । 
সুগন্ধী জাতীয় কাঠ যেমন আগর, চন্দন কাঠ ইত্যাদির ধোয়া ব্যবহার করা হত ।

তবে সর্ব প্রথম নির্যাস থেকে আতরে তথা পারফিউম অয়েলে রুপ দেন বিখ্যাত মুসলীম মনীষী এবং রসায়নবিদ ও চিকিৎসক আবু আলী ইবনে সিনা, যিনি পশ্চিমে অ্যাভিসেনা নামে পরিচিত, তিনি সর্ব প্রথম ফুলের নির্যাস থেকে সুগন্ধী তেল তথা ন্যাচারাল আতর আহরণের পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন...
আবু আলী ইবনে সিনা তিনি ছিলেন প্রারম্ভিক ইসলামিক চিকিৎসক প্রথমে গোলাপের পাপড়ি থেকে তেল বের করেছিলেন এবং এটিকে ঔষধি উদ্দেশ্যে ব্যবহার করার জন্য পাতিত জলের সাথে মিশিয়েছিলেন। এটি সুগন্ধির প্রাচীনতম রূপগুলির মধ্যে একটি ছিল। 


ইবনে সিনার জীবনী
ইতিহাসের পাতায় ইবনে সিনা

ড. মো. কামাল উদ্দিন
মানবসভ্যতার সূচনালগ্ন থেকে পারস্য জ্ঞান-বিজ্ঞান, সভ্যতা-সংস্কৃতি, শিল্প-সাহিত্যে গৌরবময় মর্যাদায় আসীন। পারস্য সাম্রাজ্য বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন সাম্রাজ্য। পারস্য তথা ইরানের রয়েছে প্রায় তিন হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্য। ইতিহাসের কালজয়ী পারস্য প্রতিভা ইবনে সিনা, আল-গাযযালি, কবি ফেরদৌসি, ওমর খৈয়াম, শেখ সাদি, রুমি, হাফিজ ও জামি। জ্ঞান-বিজ্ঞানের এক প্রোজ্জ্বল নক্ষত্র ইবনে সিনা। চিকিৎসাশাস্ত্র, দর্শন, ধর্মতত্ত্ব, গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞানে তিনি স্মরণীয় প্রতিভা। একই সাথে তিনি ইরান, তুরস্ক, আফগানিস্তান ও রাশিয়ার পণ্ডিতদের কাছে জাতীয় জ্ঞানবীর হিসেবে আখ্যায়িত। চিকিৎসাশাস্ত্রে তাঁর সাফল্য ঈর্ষণীয়। চিকিৎসাশাস্ত্রের বিশ্বকোষ আল-কানুন ফিত-তিব উনিশ শতক অবধি প্রাচ্য ও প্রাশ্চাত্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও চিকিৎসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রায় সাতশ বছরকালব্যাপী তাঁর গ্রন্থাবলি অক্সফোর্ড, কেমব্রিজসহ ইউরোপের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গুরুত্বসহকারে পঠিত হয়। চিকিৎসাশাস্ত্রের এই মহান দিকপাল ইউরোপে ‘আভিসিনা’ নামে পরিচিত। অধিবিদ্যা, যুক্তিবিজ্ঞান, নৈতিকতা, পদার্থবিজ্ঞান ও ধর্মতত্ত্বেও রয়েছে তাঁর অবিস্মরণীয় সাফল্য।
ইবনে সিনার জন্ম ৯৮০ সালে বর্তমান উজবেকিস্তানের বিখ্যাত শহর বোখারার নিকটবর্তী খার্মাতায়েন জেলার আফসানা গ্রামে। পুরো নাম হিসেবে ইরানিরা তাঁকে আবু আলী হোসাইন বিন আবদুল্লাহ বিন হাসান বিন আলী বিন সিনা আর আরবরা তাঁকে আবু আলী হোসাইন ইবনে আবদুল্লাহ আল-হাসান ইবনে আলী ইবনে সিনা হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তবে তিনি আবু আলী সিনা, ইবনে সিনা, পুরসিনা, আভিসিনা, শাইখুর রাঈস নামেও সমধিক পরিচিত। পিতার নাম আবদুল্লাহ ও মায়ের নাম সিতারা। শৈশবেই তাঁর অসাধারণ প্রতিভার স্বাক্ষর দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। মাত্র ১০ বছর বয়সে তিনি কুরআন মজিদের ৩০ পারা মুখস্থ করেন। বিখ্যাত দার্শনিক আবু আবদুল্লাহ আল-নাতেলির কাছে দর্শন ও ন্যায়শাস্ত্র শিক্ষালাভ করেন। ধর্মতত্ত্ব, ফিকাহশাস্ত্র ও তাফসিরবিদ্যায় পাণ্ডিত্য অর্জন করেন ইসমাইল সুফির কাছ থেকে। গণিতশাস্ত্রের দীক্ষা পান মাহমুদ মাস্‌সাহেবের কাছে। মাতৃভাষা ফারসি হলেও সমকালীন অন্যান্য পণ্ডিতের মতো তিনিও আরবি ভাষায় অমূল্য রত্মভাণ্ডার রচনায় ব্রতী হন।
ইবনে সিনা মাত্র উনিশ বছর বয়সে বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, অর্থনীতি, রাজনীতি, গণিতশাস্ত্র, জ্যামিতি, ন্যায়শাস্ত্র, চিকিৎসাশাস্ত্র, কাব্য, সাহিত্য প্রভৃতি বিষয়ে অর্জন করেন গভীর পাণ্ডিত্য। ২১ বছর বয়সে আল-মাজমুয়া নামক বিশ্বকোষ রচনা করেন। তিনি ছিলেন প্রখর মেধার অধিকারী। এমনকি শিক্ষাগুরু আল-নাতেলি অনুধাবন করেন তাঁকে শিক্ষা দেওয়ার মতো সামর্থ্য তাঁর নেই। ইবনে সিনা স্বীয় অত্মজীবনীতে উল্লেখ করেন : যে কোনো জটিল সমস্যার সমাধান ওস্তাদ যেরূপ করতে পারতেন আমি তার চেয়ে ভালোভাবে করতে পারতাম। এমনকি আল-নাতেলির কাছে মানতেক বা তর্কশাস্ত্রের মূলমন্ত্র অধ্যয়নের পর দেখতে পেলাম আমার আর শেখার মতো কিছু বাকি নেই। তখন গ্রন্থগুলো পুনরায় পড়তে শুরু করলাম। সববিষয়ে পারদর্শী হয়ে উঠলাম। এমনকি জ্যামিতিক জটিল সমস্যাবলি সমাধান করে শিক্ষকের কাছে যাওয়ার পর তিনি সবগুলোকেই সঠিক বলে প্রতীয়মান করলেন। আমার পাণ্ডিত্য অবলোকনের পর তিনি পিতাকে নতুন শিক্ষকের সন্ধানে জ্ঞানার্জনের পরামর্শ দেন। তারপর আমি ধর্মতত্ত্ব ও প্রকৃতিবিজ্ঞানবিষয়ক অধ্যয়নে মনোনিবেশ করি।
ইবনে সিনা অতি অল্পসময়ে অ্যারিস্টটলের দর্শন সম্পূর্ণরূপে আত্মস্থ করতে সক্ষম হন। নতুন কোনো গ্রন্থের সন্ধান না পেয়ে পুরনো বইগুলো আবার পড়তে শুরু করলেন। চতুর্দিকে যশ-খ্যাতি ছড়িয়ে পড়লে বিভিন্ন দেশ থেকে তাঁর কাছে শিক্ষার্থীরা জ্ঞানার্জনে ছুটে আসতে লাগলো। এ পর্বে তিনি চিকিৎসাবিদ্যাসম্পৃক্ত অধ্যয়নে মনোনিবেশ করেন। চিকিৎসাবিজ্ঞান সংক্রান্ত গ্রন্থাবলি সংগ্রহ করে গবেষণায় আত্মনিয়োগ করেন। তিনি স্বীয় জীবনীতে উল্লেখ করেন যে, গভীর রজনীতে গবেষণায় যখন কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারতেন না তখন নামাজ পড়ে আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করে ঘুমিয়ে পড়তেন। কখনো বা মসজিদে গিয়ে আল্লাহর সাহায্য কামনা করতেন। আর নিদ্রার মাঝেই অমীমাংসিত বিষয়গুলোর সন্ধান পেয়ে যেতেন। ঘুম থেকে উঠে তিনি সমুদয় সমস্যার সমাধান করে ফেলতেন।
বোখারার শাসক নুহ বিন মনসুর দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়লে দেশি-বিদেশি সব চিকিৎসক মিলেও তাঁকে সুস্থ করতে তুলতে পারেন নি। ততদিনে ইবনে সিনার খ্যাতিও শাসক পর্যন্ত পৌঁছে যায়, তিনি শাসককে সম্পূর্ণরূপে সারিয়ে তোলেন। বাদশাহ তাঁকে আরোগ্য লাভের স্বীকৃতিস্বরূপ বিপুল পরিমাণ পুরস্কার ঘোষণা দেন। জ্ঞানপিপাসু ইবনে সিনা বিপুল সম্পদ ও উচ্চপদ লাভের সুযোগ উপেক্ষা করে শাহী গ্রন্থাগারে প্রবেশ করে পড়াশুনার অনুমতি প্রার্থনা করেন। এ প্রার্থনা মঞ্জুর হলে তাঁর জন্য শাহী গ্রন্থাগারে অধ্যয়নের দ্বার উন্মোচিত হয়ে যায়। জ্ঞান-বিজ্ঞানের এ বিশাল ভাণ্ডার দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়েন। এ জ্ঞানভাণ্ডার ছিল তাঁর কল্পনাতীত। প্রাচীন থেকে শুরু করে সব লেখকের অমূল্য গ্রন্থে ভরপুর ছিল এই গ্রন্থাগার। গ্রন্থ ও লেখকের নামসহ তালিকা প্রস্তুত করে তিনি অধ্যয়নে মনোনিবেশ করেন। জ্ঞানার্জনের নেশায় তিনি এতটাই মগ্ন ছিলেন যে, প্রায়ই নাওয়া-খাওয়ার কথা ভুলে যেতেন। সাধনা ও অধ্যবসায়ের ফলে মাত্র অল্প কয়েকদিনের ব্যবধানেই ইবনে সিনা গ্রন্থাগারের সব কিতাব মুখস্থ করে ফেলেন। জ্ঞান-বিজ্ঞানের সব শাখায়ই তিনি পারঙ্গম হয়ে উঠেন।
ইবনে সিনা খাওয়ারিজমে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ করেন ১০০৪ সালে। এ সময় খাওয়ারিজমের বাদশাহ ছিলেন মামুন বিন মাহমুদ। সেখানে পণ্ডিত আল-বিরুনির সাথে সাক্ষাৎ হয়। স্বাধীনচেতা ইবনে সিনা ১০০৪ থেকে ১০১০ সাল পর্যন্ত খাওয়ারিজমে শান্তিপূর্ণভাবে কাটিয়ে দেন। ইবনে সিনার সুখ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়লে গজনির সুলতান মাহমুদ তাঁকে পেতে চাইলেন। সুলতান বিখ্যাত জ্ঞানী ব্যক্তিদের দেশ-বিদেশ থেকে ডেকে এনে শাহী দরবারের গৌরব বৃদ্ধি করতেন এবং তাঁদেরকে মণি-মুক্তা উপহার দিতেন। সুলতান তাঁর প্রধানশিল্পী আবু নসরকে ইবনে সিনার চল্লিশটি প্রতিকৃতি তৈরির নির্দেশ দেন। আসল ইবনে সিনাকে খুঁজে বের করার জন্য দেশে-বিদেশে সুলতান মাহমুদ প্রতিকৃতিসহ লোক পাঠিয়ে দেন। খাওয়ারিজমের বাদশাহ মামুন বিন মাহমুদকে পত্র মারফত তাঁর দরবারের জ্ঞানী ব্যক্তিদের সুলতান মাহমুদের দরবারে পাঠিয়ে দেওয়ার ইঙ্গিত করেন। আসলে অন্যান্য জ্ঞানী ব্যক্তির সঙ্গে ইবনে সিনাকে পাওয়াই ছিল তাঁর মূল উদ্দেশ্য।
ইবনে সিনার বহুদেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতার ঝুলি ছিল সমৃদ্ধ। আল-বিরুনি ভারতবর্ষের প্রতি অনুরাগী হলেও ইবনে সিনার মনোযোগ ছিল ভারতবর্ষের উল্টো দিকে। তাঁর মূল উৎসাহ ছিল পশ্চিমের দিকে। ইবনে সিনার চিকিৎসাবিষয়ক বইগুলো প্রাচ্যের সীমানা ছাড়িয়ে পাশ্চাত্য জগতে স্থায়ী আসন তৈরি করে নেয়। খাওয়ারিজম শহর থেকে বিদায় নিয়ে তিনি রাজধানী শহর গুরুগঞ্জে উপস্থিত হন। এ শহরে জীবনের বেশ কিছু সময় অতিবাহিত করেন। এখানে অবস্থানকালে চিকিৎসাবিদ্যাবিষয়ক অমর গ্রন্থ আল-কানুন ফিত তিব রচনা করেন। এরপর তিনি যান পূর্ব পারস্যের খোরাসান শহরে। সুলতান মাহমুদ ইবনে সিনাকে আবার দরবারে নিয়ে যাওয়ার জন্য দিকে দিকে দূত প্রেরণ করেন। এবার নিজ দরবার নয়, সুলতান মাহমুদের ইচ্ছা ছিল তাঁর জামাতা খাওয়ারিজম অধিপতির দরবারকে জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিদের দ্বারা সুশোভিত করা। ইবনে সিনাকে তিনি চেয়েছিলেন সভাসদ হিসেবে। কিন্তু কিছু বিষয়ে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছিল সুলতান মাহমুদের সাথে ইবনে সিনার।
ইবনে সিনা ছিলেন স্বাধীনচেতা। তিনি জর্জন নামক স্থানে পালিয়ে যান। সুলতান মাহমুদ এ খবর জানতে পেরে জর্জনের অধিপতিকে ফরমান পাঠান যেন ইবনে সিনাকে হস্তান্তর করা হয়। এমন পরিস্থিতি তৈরি হলে ইবনে সিনা এবার জর্জন থেকেও পালিয়ে গিয়ে আবার নিরুদ্দেশ যাত্রা করেন। তিনি ইরানের খোরাসান হয়ে যাওয়ার পথে তুসে সমসাময়িক কবি আবুল কাসেম ফেরদৌসির বিখ্যাত তুস নগরী পরিদর্শন করেন। এ যাত্রায় তিনি রেই শহর হয়ে হামেদানে এসে উপনীত হন। হামেদান নগরী ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞান ও ঐশ্বর্যের এক কেন্দ্রস্থল। সম্রাট শামসুদ্দৌলা তাঁকে সম্মানের আসনে রাখেন, আর তিনিও গবেষণার উপযুক্ত পরিবেশ পেয়ে যান। চিকিৎসাসেবার পাশাপাশি তিনি অধিবিদ্যা, ধর্মতত্ত্ব এবং দর্শনের মৌলিক বিষয়ে গবেষণায় মনোনিবেশ করেন। এখানেই রচিত হয় বিখ্যাত গ্রন্থ কিতাব আল-শিফা।
ভ্রমণ পরিক্রমায় ১০৩৪ থেকে ১০৩৭ সাল পর্যন্ত ইবনে সিনার অতিবাহিত হয় ইসফাহানে। শাসক আলাউদ্দৌলা তাঁকে সম্মান ও মর্যাদার আসনে সমাসীন করেন। হামেদানের সাথে ইসফাহানের যুদ্ধ সংঘটিত হলে শাসকের অনুরোধ রক্ষায় তিনিও সফরসঙ্গী হিসেবে হামেদানে পৌঁছেন। যুদ্ধশিবিরেই ইবনে সিনা অসুস্থ হয়ে ১০৩৭ সালে মৃত্যুবরণ করেন। হামাদানেই তাঁকে সমাহিত করা হয়। ইরানের খ্যাতিমান আধুনিক কবি আরেফ কাজভিনির সমাধিও হামাদানে।
বহুমমুখী প্রতিভাধর ইবনে সিনার পদার্থবিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব, জ্যামিতি, গণিত, চিকিৎসাবিজ্ঞান, সাহিত্য প্রভৃতি বিষয়ে ১১১টি গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যায়। তন্মধ্যে কানুন ফিত্ তিব (চিকিৎসাবিজ্ঞান), কিতাব আল-শিফা ( আরোগ্যতত্ত্ব) এবং কিতাব আল-ইশারাৎ (বিবিধ অনুশীলনী) সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ। কানুন ফিত-তিব সর্বপ্রথম ১০২৫ সালে আরবি ভাষায় প্রকাশ পায়। এটি আঠারো খণ্ডে সমাপ্ত। ল্যাটিন, ইংরেজি ও হিব্রু ভাষায় তা অনূদিত হয়। কানুনে প্রায় শতাধিক জটিল রোগের কারণ, লক্ষণ, পথ্যাদির বিস্তারিত ব্যাখ্যা রয়েছে। ইবনে সিনা ফার্মাকোলজি ও ক্লিনিক্যাল প্র্যাকটিসের উন্নয়ন করেন। তবে তাঁর মূল কর্মক্ষেত্র ছিল চিকিৎসাশাস্ত্র। তিনি হলিস্টিক মেডিসিনের প্রণেতা। একই সাথে শারীরিক, মানসিক এবং আত্মিক যোগসূত্রকে বিবেচনায় রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়। তিনি মানুষের চোখের সঠিক এনাটমি বর্ণনা করেন। সুদীর্ঘকাল আগেই তিনি বলে যান যক্ষ্মা একটি ছোঁয়াচে রোগ। যা পরবর্তীকালে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় সঠিক বলে প্রমাণিত হয়। সত্যিই ইবনে সিনা আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের জনক।
ইবনে সিনার ‘কিতাব আল-শিফা’ (আরোগ্যতত্ত্ব) একটি বিশ্বকোষ। এটিও আঠারো খণ্ডে সমাপ্ত। এতে রয়েছে পদার্থবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান, এরিস্টটলীয় দর্শনসহ নানাবিধ বিষয়ের সমাহার। দ্বাদশ শতকে এটি ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয় ও ইউরোপে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। মধ্যযুগের ইউরোপীয় বিজ্ঞানী-দার্শনিকদের নিকট এটি সমাদৃত হয়। গ্রন্থটির পদার্থবিজ্ঞান অধ্যায়ে ইবনে সিনা প্রমাণ করেন যে, বিশ্বের মৌলিক বস্তুসমূহ প্রকৃতি যেভাবে বিভিন্ন শ্রেণিতে বিন্যস্ত করেছে তা পরিবর্তন করা মানুষের সাধ্যাতীত। ‘কিতাব আল-ইশারাত’ তাঁর পরিণত বয়সের রচনা। দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধের সংকলন। মানব সমাজের বহু চিরন্তন সমস্যার আলোকপাত রয়েছে এতে। সৃষ্টিরহস্য উন্মোচিত করার অব্যক্ত প্রয়াস। পঞ্চম অধ্যায়ে সুফিতত্ত্বের গূঢ় রহস্য, পরমাত্মার সাথে মানবাত্মার মিলনাকাক্সক্ষার আকুতি ব্যক্ত হয়। আধ্যাত্মিক সাধনার পথে যেসব স্তরপরিক্রমা অতিক্রম করতে হয় তা যেন ফুটে ওঠে ধাপে ধাপে।
ইবনে সিনার বিখ্যাত গ্রন্থাবলি হলো ‘কিতাবুল মাজমু’, ‘কিতাবুল হাসিল ওয়াল মাহসুল’, ‘কিতাবুল র্বির ওয়াল ইসম’, ‘কিতাবুল আরসাদিল কুল্লিয়্যাহ’, ‘কিতাবুল ইনসাফ’, ‘কিতাবুন্নাজাহ’, ‘কিতাবুল হিদায়াহ’, ‘কিতাবুল মুখতাসারিল আওসাত’, ‘কিতাবুল আলাঈ’, ‘কিতাবু লিসানিল আরাব ফিল-লুগাহ’, ‘কিতাবুল আদভিয়াহ আল-ক্বালবিয়াহ’, ‘কিতাবুল মুজিয’, ‘কিতাবু বাযিল হিকমাহ আল-মাশরাফিয়্যাহ’, ‘কিতাবুল মাআদ’ প্রভৃতি।
ইবনে সিনার অমর গ্রন্থাবলি আরবিতে রচিত হলেও ফারসি ভাষায়ও তাঁর অবদান স্বীকৃত। অধিকাংশ গবেষকের মতে, তাঁর ফারসি গ্রন্থের সংখ্যা ২০টি। বহুমুখী প্রতিভাধর ইবনে সিনার কাব্যজগতেও রয়েছে সফল পদচারণা। ফারসি ও আরবি দুভাষাতেই তাঁর কাব্যচর্চার নিদর্শন বিদ্যমান। ফারসি পঙ্‌ক্তির সংখ্যা ৭২টি হিসেবে বিভিন্ন গ্রন্থে আলোকপাত করা হয়েছে। তাঁর ব্যঙ্গ-বিদ্রূপাত্মক ফারসি কবিতায় পাঠকহৃদয় আলোড়িত হয়। বৈশ্বিক জীবনের অসারতা, মানুষের অপারগতা-অক্ষমতা কাব্যদর্শনের প্রধান উপজীব্য। কাব্যজুড়ে রয়েছে জীবন ও সৃষ্টিজগের রহস্য উদ্ঘাটনের তীব্র বাসনা। জীবন-রহস্য উন্মোচনের প্রবল আকুতি দৃশ্যমান হয়ে ওঠে শ্লোকের বাঁকে বাঁকে। একজন শক্তিমান কবির বহুমাত্রিক বৈশিষ্ট্যও চিত্রিত হয় ইবনে সিনার কবিতায়।
روزکی چند در جهان بودم
بر سر خاک باد پیمودم
ساعتی لطف و لحظه ای در قهر
جان پاکیزه را بیالودم
باخرد را به طبع، کردم هجو
بی خرد را به طمع بستودم
آتشی برافروختم از دل
و آب دیده ازو بیالودم
با هواهای حرص شیطانی
ساعتی شادمان بنغودم
آخر العمر چون سرآمد کار
رفتم تخم کشته بدرودم
گوهرم باز شد به گوهر خویش
من از این خستگی بیالودم
کس نداند که من کجا رفتم
خود ندانم که من کجا بودم
دل گرچه درین بادیه بشتافت
یک موی ندانست ولی موی شکافت
اندر دل هزار خورشید بتافت
آخر به کمال ذره ای راه نیافت

এ ধরণীতে ছিলাম কিছুকাল
অহংকারে ভ্রমণ করেছি মাটির ওপর।
কখনো দয়ায় আবার কখনো ক্রোধে
পবিত্র হৃদয় আঙিনাকে করেছি কলুষিত।
জ্ঞানীকে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপে করেছি জর্জরিত
লালসায় ডুবে মুর্খের করেছি প্রশংসাবাণী।
অন্তরকে দ্বগ্ধ করেছি বহ্নিশিখায়
চোখের জলকে করেছি অপমান।
শয়তানি লোভ-লালসায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে
আনন্দ-উচ্ছাসে বাজিয়েছি গানের সুর।
জীবনসায়াহ্নে চূড়ান্ত পরিণতির কালে
ফসলের বীজ বপনে করলাম মনোনিবেশ।
অর্জিত মণি-মুক্তা এসে যুক্ত হলো আমার ভাণ্ডারে
আলস্য-অবহেলায় যাপিত জীবন বয়ে আনলো অপমানের ঝুড়ি।
জানে না কেউ কীইবা আমার পরিণতি
নিজেও জানি না কোথায় ছিলাম আমি।
যদিও হৃদয় এই পথে-প্রান্তরে ছুটে চলেছে তীব্রবেগে
একটি পশমও জানেনি কিছুই যদিও চির ধরেছে চুলে।
হৃদয় আঙিনায় সহস্র সূর্য বিকিরণ করেছে আলো
অথচ জীবন মোর এক বিন্দুও পায়নি পথের দিশা।

ইবনে সিনা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের এক প্রোজ্জ্বল নক্ষত্র। যাঁর আলোকচ্ছটায় বিশ^বাসী প্রায় নয় শতকব্যাপী আলোকিত হয়ে আসছে। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের জনক ইবনে সিনার জন্মদিন শাহরিভার মাসের ১ তারিখ ইরানে চিকিৎসা দিবস হিসেবে পালিত হয়। ইরান, তুরস্ক, ফ্রান্স, আফগানিস্তান, বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ইবনে সিনার নামে চিকিৎসাবিজ্ঞানবিষয়ক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। ইউনেস্কো প্রতি দুবছর অন্তর ইবনে সিনা পুরস্কার দিয়ে থাকে। চিকিৎসাশাস্ত্র, পদার্থবিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব, জ্যামিতি, গণিত, সাহিত্যসহ জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রায় সব শাখায় রয়েছে তাঁর সফল বিচরণ। বিশেষত তাঁর মেডিকেল বিশ্বকোষ ‘আল-কানুন ফিত-তিব’ উনিশ শতক অবধি মুসলিম বিশ্ব ও ইউরোপে সিলেবাসভুক্তভাবে পঠিত হয়। ইউনানি চিকিৎসায় তা অদ্যাবধি যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করে আসছে। বহুমুখী প্রতিভাধর ইবনে সিনা যুগ যুগ ধরে মানবহৃদয়ে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন স্বীয় কর্মের মাধ্যমে।

প্রফেসর, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *